প্রথম আলো, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮
বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর কাছে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে একটা বড় ভূমিকা রাখেন রাষ্ট্রদূত বা কূটনীতিকেরা। দায়িত্বটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি পেশা হিসেবেও এটি বেশ সম্মানজনক। বিসিএস পরীক্ষায় তাই তরুণদের পছন্দের তালিকায় ওপরের দিকে থাকে পররাষ্ট্র ক্যাডার। কূটনীতিক হতে চাইলে কীভাবে নিজেকে তৈরি করা উচিত? এ সময়ের তরুণদের জন্য লিখেছেন ফিলিপাইনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আসাদ আলম সিয়াম
স্থপতি হওয়ার বাসনায় ভর্তি হয়েছিলাম বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)। কূটনীতিক হওয়ার ভাবনাটা কখনো মাথায় আসেনি। পরে তো জীবনের গতিপথটাই গেল বদলে। তবে এটা স্বীকার করব, অন্য অনেকের মতো আমারও সরকারি চাকরির প্রতি আগ্রহ ছিল।
২৩ বছরের কাজের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, প্রথম পছন্দ হিসেবে বিসিএস পরীক্ষায় কূটনীতি রাখলে অন্যভাবে নিজেকে তৈরি করতাম। সে ক্ষেত্রে পড়াশোনা যে বিষয়েই করি না কেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সমসাময়িক বিষয়, রাজনীতি এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলোর কাজের ধারা নিয়ে খুব স্পষ্ট ধারণা থাকলে ভালো। আরও পরিষ্কার করে বললে বলা যায়, প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার বাইরে ইতিহাস, অর্থনীতি, বাণিজ্য এসব বিষয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি গণমাধ্যমের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখা খুব জরুরি।
একজন কূটনীতিক পেশাগত কাজের বিভিন্ন স্তরে দেশের সেলসম্যান বা বিক্রয়কর্মী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেন। তাই নিজের দেশ সম্পর্কে ভালোভাবে জানাটা অপরিহার্য। দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, শিল্পকলা, সাহিত্যসহ নানা বিষয়ে জানতে ও বুঝতে হবে। এ বিষয়গুলো আত্মস্থ করে নিজের মধ্যে এক ধরনের গর্ববোধের জায়গা তৈরি করাটা জরুরি। দেশ নিয়ে নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে, তবেই অন্য দেশের কাছে নিজের দেশকে তুলে ধরা যাবে।
একজন কূটনীতিককে যোগাযোগ বা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে খুব সাবলীল হতে হয়। ভালো বাংলা ও ইংরেজি জানার কোনো বিকল্প নেই। কারণ, নিজেকে অন্যের কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরতে হবে। আমি কী ভাবছি, আমার সঙ্গে অন্যের সেতুবন্ধন কীভাবে হতে পারে সেটা স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে না পারলে, আমি এগোতে পারব না। তাই সহজ ও সাবলীলভাবে নিজেকে উপস্থাপনের প্রস্তুতি থাকতে হবে। যাঁরা কূটনীতিক হতে আগ্রহী, তাঁদের বাংলা ও ইংরেজির পাশাপাশি তৃতীয় একটি ভাষায় দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করা উচিত। এ ক্ষেত্রে তাঁরা জার্মান, স্প্যানিশ, আরবি ও মান্দারিন ভাষার কথা ভাবতে পারেন।
ভাষার দক্ষতা যে কতখানি জরুরি, সেটা বোঝাতে আমার একটা মজার অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি। একটি মিশনে আমার সঙ্গে স্থানীয় এক কর্মী কাজ করতেন। তিনি ‘কনফার্ম’ আর ‘ইনফর্ম’ শব্দ দুটো গুলিয়ে ফেলতেন। প্রতিবারই কারও সঙ্গে বৈঠকের ব্যাপারে জানাতে বললে (ইনফর্ম) সে তা নিশ্চিত (কনফার্ম) করে ফেলত। আবার কখনো কখনো আমরা বৈঠকের জন্য তৈরি হয়ে থাকতাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বৈঠক আর হতো না। পরে বুঝতে পেরেছি, আমরা হয়তো বৈঠকের সময়টা নিশ্চিত (কনফার্ম) করেছি, কিন্তু অন্য পক্ষকে কেবল বৈঠকের ব্যাপারে অবহিত (ইনফর্ম) করা হয়েছে।
আরেকটা মজার অভিজ্ঞতার কথা বলি। একবার একটি দেশে কাজ করার সময় বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে আমরা অতিথিদের হাতে রজনীগন্ধার গুচ্ছ তুলে দিই। এতে করে অতিথিরা ভড়কে যান। পরে জেনেছি, ওই দেশে শুধু শবযাত্রায় সাদা ফুল ব্যবহার করা হয়!
পেশাগত জীবনের নানা পর্বে আমাকে একেকটা ‘টাইমজোনে’ কাজ করতে হয়েছে। ফলে একজন কূটনীতিককে ধরে নিতে হয়, তাঁর কাজটা ২৪ ঘণ্টার। ঢাকায় যখন দাপ্তরিক কাজ শেষ হচ্ছে, ঠিক তখন নিউইয়র্কে দিনের কাজ শুরুর প্রস্তুতি চলছে। তাই কাজ করতে গিয়ে পরিবর্তিত সময়ের পাশাপাশি চারপাশের নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটাও জরুরি। নানা পর্বে নানা ধরনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এগুলো রপ্ত করার চেষ্টা থাকতে হবে। এ ছাড়া সময়ানুবর্তিতা, শিষ্টাচার, এসবের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে সচেতনভাবে।
কূটনীতিকদের চাকরি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ভুল ধারণা প্রচলিত। সেটা হচ্ছে, এই চাকরির সুবাদে নানা দেশে ঘোরাঘুরি করা যায়। এটা ঠিক নয়। কূটনীতিকদের বিদেশ সফরের বড় উপলক্ষ বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে ঘিরে। সেখানে সভা-সমাবেশের সময়টা বাদ দিলে তাঁদের ঘুরে বেড়ানোর সময়টা সীমিত। তবে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, বিদেশে অবস্থানের কারণে একটি দেশ, সে দেশের মানুষ, সেখানকার নানা কিছু সম্পর্কে অনেক ভালোভাবে জানার ও বোঝার সুযোগ তৈরি হয়। যেটা একজন পর্যটকের পক্ষে সম্ভব নয়।
নানাভাবে একজন কূটনীতিক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ওঠেন। বিশ্বের নানান সংকট ও উল্লেখযোগ্য উদ্যোগের প্রক্রিয়ায় যুক্ত থেকে ইতিহাসের উপাদান হতে পারেন। বহুপক্ষীয় নানা উদ্যোগে একজন কূটনীতিককে দেশের কথা ভেবে, বিশেষ করে দেশের স্বার্থকে সমুন্নত রেখেই নৈর্ব্যক্তিক আচরণ প্রকাশে সচেষ্ট থাকতে হয়।
কূটনীতিক হতে গিয়ে একজন ব্যক্তিকে অনেক ধরনের ত্যাগ স্বীকারে তৈরি থাকতে হয়। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ত্যাগ হচ্ছে নিজের আপনজন, প্রিয় স্বদেশের কাছ থেকে দূরে থাকা। এ বিষয়টি শুরুতে বেশ নাড়া দেয়। তাই এই পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সচেতন হতে হয়।
সব শেষে গুরুত্বপূর্ণ হলো, দেশের সেবার মানসিকতা থেকে অনাবাসী বাংলাদেশি এবং অভিবাসীদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আন্তরিক ইচ্ছা থাকতেই হবে।
ধাপে ধাপে রাষ্ট্রদূত
ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এবং ঢাকার বাইরে ৫৮টি দেশের ৬৬টি মিশনে সব মিলিয়ে পদ আছে প্রায় ৩৭৫টি।
পররাষ্ট্র ক্যাডারে শুরুতে একজন কর্মকর্তা মন্ত্রণালয়ে সহকারী সচিব পদে যোগ দেন। পদক্রম অনুযায়ী পরবর্তী পদগুলো হলো সিনিয়র সহকারী সচিব, পরিচালক, মহাপরিচালক, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব। এক্ষেত্রে মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পদোন্নতি নির্ধারন করা হয়।
যোগ দেওয়ার পরপরই একজন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলকভাবে ফরেন সার্ভিস একাডেমি থেকে একটি প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এ ছাড়া অন্য ক্যাডারদের মতো বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রেও তাঁরা প্রশিক্ষণে অংশ নেন। চাকরি জীবনের বিভিন্ন স্তরে ভাষা বা কূটনীতির নানা বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের জন্য আরও নানা প্রশিক্ষণ নিতে হয় কূটনীতিকদের।
কূটনীতিক হিসেবে দূতাবাসে বা মিশনে একজন বিসিএস ক্যাডারের কর্মজীবন শুরু হয় তৃতীয় সচিব হিসেবে। পরের পদক্রম হলো দ্বিতীয় সচিব, প্রথম সচিব, কাউন্সেলর, মিনিস্টার এবং সব শেষে রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনার। রাষ্ট্রদূত হতে হলে কূটনীতিক হিসেবে দীর্ঘ অভিজ্ঞতার প্রয়োজন রয়েছে। তবে অনেক সময় সমাজের বিশিষ্টজন, রাজনীতিবিদ, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদেরও সরকার রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগ দিয়ে থাকে।
স্বপ্ন নিয়ে প্রতিবেদক