বই পড়া ভারি মজা
বইয়ের নামঃ বিশ্ব রাজনীতির ১০০ বছর
লেখকঃ তারেক শামসুর রেহমান
রিভিউ লিখেছেনঃAbdullah Al Arif
“বিংশ শতাব্দীর যে বিষয়গুলো বিশ্ব রাজনীতিতে আলোড়ন তুলেছিল, তা বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এই গ্রন্থটিতে।”- এভাবেই লেখক তারেক শামসুর রেহমান নিজে এই বইটির প্রারম্ভিক বিবরনে লিখেছেন। সুতরাং বিগত শতাব্দী অর্থাৎ ১৯০১ থেকে ২০০০ সালের ঘটনাবলী এই বইএর প্রধান আলোচ্য বিষয়। এই শতাব্দীতেই সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা দুটি ঘটেছে।
তা হল, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সাবলীল বিবরন রয়েছে। যুদ্ধের ফলাফল, গুরুত্ব এবং জার্মানির পরাজয়ের কারন ইত্যাদি বিষয়াবলি বিশদভাবে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে একদম পয়েন্ট করে উপস্থাপিত হয়েছে।
গ্রন্থটির পঞ্চম অধ্যায়ের নাম ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপীয় রাজনীতি’।এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট বুঝানো হয়েছে যৌক্তিকভাবে। আমরা জানি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ হিসেবে লীগ অব নেশনসের ব্যর্থতাকে দায়ী করা হয়। এই বিষয়টিও মূল্যায়ন করা হয়েছে বইটির চতুর্থ অধ্যায়ে। এই অধ্যায়ের এক জায়গায় লেখক বর্ননা করছেন- “লীগের চুক্তিপত্র ভার্সাই সন্ধির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। সুতরাং ভার্সাই চুক্তি অনুমোদন না করার অর্থ হল লীগ অব নেসনসএ যোগদানের সম্ভাবনা বাতিল করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতি ছিল লীগ অব নেশনসের উপর প্রচন্ড আঘাতস্বরূপ।”
বর্তমান বাইপোলার বিশ্বব্যবস্থার বীজ রোপিত হয়েছিল ১৯১৭ সালের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে। ইতিহাসে আমরা এটাকে রুশ বিপ্লব বা অক্টোবর বিপ্লব হিসেবে দেখতে পাই। পশ্চিম ইউরোপে তখন পুজিবাদের চর্চা চলছিল আর রাশিয়ায় শুরু হল সমাজতন্ত্রের মহাযাত্রা। বইটির তৃতীয় অধ্যায়ে এই বিপ্লবের একটি স্বচ্ছ ধারনা দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ দুটি বৃহৎ শক্তিতে বিভক্ত হতে শুরু করে। পূর্ব ইউরোপের নেতৃত্বে থাকে সোভিয়েত ইউনিয়ন। তাদের সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ ধীরে ধীরে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়। ষষ্ঠ অধ্যায়ে লেখক বর্ননা করছেন-“পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোতে একদলীয় শাসন কায়েম হয়। বেড়ে যায় সোভিয়েত আধিপত্য ও আগ্রাসন। এই আধিপত্যবাদদের কবল থেকে মুক্তির জন্য আশির দশকের শেষ দিকে পূর্ব ইউরোপ জুড়ে দাবী ওঠে গনতন্ত্রের।” এই অধ্যায়ে পেরেস্ত্রোইকা, গ্লাসনস্ত সহ বিভিন্ন জটিল বিষয়েরও সুন্দর ও সাবলীল ব্যাখ্যা উপস্থাপিত হয়েছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতন্ত্র তখন পশ্চিমাদের নিকট ছিল একটি অজানা আতংক। তাদের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তা চেতনার উপর এটি ছিল বড় ধরনের আঘাত। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র অনুধাবন করল দুটি উপায়ে এই সমাজতন্ত্রের বিকাশ রোধ করা যেতে পারে। প্রথমত ইউরোপসহ সারা বিশ্বে গনতন্ত্র জনপ্রিয় করা। দ্বিতীয়ত, পারমানবিক অস্ত্র সমৃদ্ধকরনের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নকে চাপে রাখা। সোভিয়েত ইউনিয়নও তখন চুপ করে বসে থাকল না। তারাও শুরু করল পারমানবিক অস্ত্র সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম। সুতরাং বিশ্ববাসী তখন দেখতে পেল এক নতুন ধরনের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। স্নায়ু যুদ্ধ। সপ্তম অধ্যায়ে লেখক স্নায়ুযুদ্ধ, এর কারন, ফলাফল এবং যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বৈরী সম্পর্ক বিশদভাবে তুলে ধরেছেন।
বইটির অষ্টম অধ্যায়ে জাতিসঙ্ঘ, নবম অধ্যায়ে চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এবং দশম অধ্যায়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধের যৌক্তিক ব্যাখ্যা উপস্থাপিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী শক্তি এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক শক্তি বিশ্বের অধিকাংশ দেশকে গ্রাস করে নিচ্ছিল। অনেক দেশ অনেকটা নিরুপায় হয়েই ধীরে ধীরে এই দুই ব্লকে যোগ দিতে শুরু করল । বিশ্ব তখন দ্বিধাবিভক্ত এবং বিশ্বব্যবস্থা তখন শক্তিসাম্যের জ্বরে ভুগছে। এমন সময়ে ভারতের পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু, সাবেক যুগশ্লাভিয়ার মার্শাল টিটো, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ন, মিশরের নাসের এবং ঘানার নক্রমা আবিষ্কার করলেন এক নতুন বিশ্বমেরু। নাম দিলেন ন্যাম(NAM: Non-Aligned Movement) বা জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন। তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশ খুঁজে পেল এক নতুন আশ্রয়। তারেক শামসুর রেহমান একাদশ অধ্যায়ে বলছেন-“ন্যাম আন্দোলন দুটি পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বলয়ের বাইরে থেকে বিংশ শতাব্দীর বৈশ্বিক রাজনীতিতে তাদের অবদান রেখে গেছে।”
নব্বইএর দশকে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন দূর্বল হয়ে আসে, ভেঙ্গে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। অবসান ঘটে স্নায়ু যুদ্ধের। শুরু হয় পরমানু নিরস্ত্রিকরণ আন্দোলন। এই সব বিষয় স্থান পায় ‘সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পতন শীর্ষক ষোড়ষ অধ্যায়ে।
এই শতাব্দীর আরও একটি গুরুত্তবপূর্ণ ইস্যু যা কোন ভাবেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না, তা হল বিশ্ব রাজনীতিতে মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম বিশ্বের প্রভাব। লেখক মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কট তুলে ধরেছেন ত্রয়োদশ অধ্যায়ে এবং আফগানিস্তানকে নিয়ে আলাদা করে লিখেছেন পঞ্চদশ অধ্যায়ে। এছাড়া দ্বাদশ অধ্যায়ে দক্ষিন আফ্রিকার বর্নবাদ বৈষম্য এবং চতুর্দশ অধ্যায়ে লিখেছেন চীনের সংস্কার নীতি নিয়ে।
ভূ-রাজনৈতিক অন্তর্কলহ এই বইএর অধিকাংশ পৃষ্ঠা দখল করে নিলেও লেখক তারেক শামসুর রেহমান যে আধুনিক এবং ভবিষ্যতের বিশ্বকে নিয়েও ভেবেছেন তার প্রমাণ মেলে সপ্তদশ, অষ্টদশ এবং উনবিংশ অধ্যায়ে। নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আলোকে গ্যাট চুক্তি, ডাব্লিউ টি ও সহ বিভিন্ন অর্থনৈতক জোট এবং অর্থনৈতিক বিভক্তি কারণ অনুসন্ধান করেছেন। বিশ্ব পরিবেশগত সমস্যার সমাধানকল্পে কিয়োটো প্রটোকল, প্যারিস সমঝতাসহ বিভিন্ন পরিবেশ সংক্রান্ত চুক্তি এবং এ বিষয়ে বাংলাদেশের নিরাপত্তায় করনীয় সম্পর্কে বিশদ বর্ননা রয়েছে এই অধ্যায়গুলোতে।
অদূর ভবিষ্যতে বৈশ্বিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করতে গিয়ে লেখক তারেক শামসুর রেহমান বিখ্যাত গবেষক হান্টিংটিন প্রনীত ভবিষ্যৎ বিশ্বের ‘সভ্যতার সংকট’কে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে-“হার্ভাডের শিক্ষক প্রফেসর হান্টিংটন যে ধারনাটি উপস্থাপন করেছিলেন, তাতে তিনি বলতে চেয়েছিলেন মুসলমানদের সাথে খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের দ্বন্দ্বই একুশ শতকে প্রাধান্য পাবে। তার এই বক্তব্য মুসলিম বিদ্বেষী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং অনেক বিশেষজ্ঞ এর বিরুদ্ধে মতামত দেন।” ‘সভ্যতার সংকট ও নয়া বিশ্বব্যবস্থার সরুপ’ শীর্ষক এই বইএর সর্বশেষ- ঊনবিংশ অধ্যায়ের আলোচনা, যে কোন পাঠককে ভবিষ্যতের ভূ-রাজনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে আরও বেশি পড়াশুনায় আগ্রহী করে তুলতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।
#ধন্যবাদ।