বাংলাদেশ বিষয়াবলি :
অপারেশন সার্চলাইটঃ
----------------------------
বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এমন ভয়ানক রাত আগে কখনো আসে নি।১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত।শুরু হলো বাঙালি জাতিসত্তাকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এক পরিকল্পিত সামরিক অভিযান যার নাম অপারেশন সার্চলাইট।এটি ভয়াল গণহত্যার নীল নকশা;যার প্রস্তুতি চলছিল বেশ আগে থেকেই।
গণহত্যার প্রস্তুতি ঃ
অপারেশন সার্চলাইটের সিদ্ধান্ত হয়েছিলো একাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাসে।১৯৭২ সালের প্রকাশিত সাংবাদিক পেইনের ম্যাসাকার বইতে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের ২২ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত এক সামরিক বৈঠকে ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের খতম করার সিদ্ধান্ত নেন। এই সেনা বৈঠকে ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, Kill three million of them,and the rest will eat out of our hands.
এর ফলে পাকিস্তান বাহিনীর ১৪ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা এবং ৫৭ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খান ১৯৭১সালের ২২ ফেব্রুয়ারি অপারেশন সার্চলাইট নামে একটি সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন।
১৭মার্চ চীফ অব স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ
খানের নির্দেশে জেনারেল রাজা পরদিন ঢাকা সেনানিবাসে জিওসি অফিসে অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন।পঁাচ পৃষ্ঠার এই পরিকল্পনা রাও ফরমান আলী নিজহাতে লিখেন।
৩রা মার্চ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত অস্ত্র ও রসদবোঝাই এম.ভি সোয়াত জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৫ইমার্চ থেকে ২৪শে মার্চ ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে আলোচনার ভান করে আসলে অভিযানের প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ করেন।
আর এদিকে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২৪-২৫ মার্চ জেনারেল হামিদ, জেনারেল মিঠঠি, কর্নেল সাদউল্লাহ হেলিকপ্টারে করে বিভিন্ন সেনানিবাসের প্রস্তুতি পরিদর্শন করেন।সিদ্ধান্ত হয় যে ২৫ মার্চ রাত একটায় অপারেশন সার্চলাইটের আওতায় অভিযানে ঢাকায় নেতৃত্ব দেন রাও ফরমান আলী।এই জেনারেল তার ডায়রিতে লিখেছেন, "Paint the green of East Pakistan red"
অপারেশন সার্চলাইটঃ
অপারেশন সার্চলাইট অভিযান শুরুর সময় নির্ধারিত ছিলো ২৬মার্চ রাত একটা। কিন্তু ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তঁার বৈঠকে কোনো ইতিবাচক ফলাফল না পেয়ে সবাইকে সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্য তৈরি হওয়ার আহবান জানান।বঙ্গবন্ধুর আহবানে সে রাতেই ঢাকার বিভিন্ন স্হানে মুক্তিকামী বাঙালি প্রতিরোধ ব্যবস্হা গড়ে তোলে।এরই ফলশ্রুতিতে দুটি সিদ্ধান্ত হয়
১.অপারেশন বিগবার্ড(বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার)
২.গণহত্যার অভিযানের সময় এগিয়ে নেওয়া
অপারেশন সার্চলাইট অনুযায়ী ঢাকা শহরে গণহত্যার মূল দায়িত্ব দেওয়া হয় পাক-হানাদার বাহিনীর মেজর রাও ফরমান আলীকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমেই ঢাকা শহরের পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টার এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনের নিয়ন্ত্রণভার পাকিস্তানি সেনাদের গ্রহণ করার কথা ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণ, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, রেডিও টেলিভিশন নিয়ন্ত্রণ, স্টেট ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ, আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেফতার, ঢাকা শহরের যাতায়াত ব্যবস্হাসহ শহর নিয়ন্ত্রণ ছিল সৈন্যদের প্রাথমিক দায়িত্ব।অপারেশন সার্চলাইটের আওতায় রাজশাহী, যশোর, খুলনা, রংপুর, সৈয়দপুর, কুমিল্লা সেনাবাহিনী, ইপিআর, আনসার, পুলিশের বাঙালি সদস্যদের নিরস্ত্র করার কথা উল্লেখ ছিল।চট্টগ্রাম বন্দর ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্হাপনা দখলের রাখাও তাদের লক্ষ্য ছিল। ঢাকার বাইরে এ অপারেশনের প্রধান দায়িত্ব দেওয়া হয় মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজাকে।সার্বিকভাবে এ পরিকল্পনা তত্ত্বাবধান করেন গর্ভনর মেজর জেনারেল টিক্কা খান৷
অপারেশন সার্চলাইটের আওতায় গণহত্যাঃ
পাকিস্তানি সৈন্যরা ২৫শে মার্চ রাত সাড়ে এগারোটায় ঢাকা সেনানিবাস থেকে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে।এসময় তাদের প্রথম আক্রমণের শিকার হয় ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় মিছিলরত মুক্তিকামী বাঙালিরা।একই সাথে আক্রমণ চালানো হয় পিলখানা ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে।বাঙালি সৈন্যরা পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করে।কিন্তু মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সৈন্যদের পরিকল্পিত আক্রমণ ঠেকানোর মতো অস্ত্র ও প্রস্তুতি ছিলনা তাদের।ফলে পাকিস্তানি সেনারা সে রাতে তাদের অনেককেই নির্মমভাবে হত্যা করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে আক্রমণ পরিচালিত হয় গভীর রাতে। ইকবাল হল(জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হলে ঢুকে পাকিস্তানি সেনারা গুলি করে অনেক ঘুমন্ত ছাত্রকে হত্যা করে।ঢাকা হল (শহীদুল্লাহ্ হল)সহ বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা এবং রোকেয়া হলেও তারা ব্যপক হত্যাযজ্ঞ চালায়।মার্চের এই গণহত্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষক সহ ৩০০ জন ছাত্র ও কর্মচারী নিহত হয়।জহরুল হক সংলগ্ন রেলওয়ে বস্তিতে সেনাবাহিনী আগুন দিলে ব্যপক ধংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়।শুধু ২৫শে মার্চ রাতেই ঢাকায় সাত থেকে আট হাজার নিরীহ মানুষ মারা যায়।
অপারেশন সার্চলাইট অনুযায়ী, রাত দেড়টায় (২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে) বঙ্গবন্ধুকে তঁার ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাসা থেকে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রেফতার করে।তবে এর আগেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষনার মাধ্যমে দেশবাসীকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবান জানান।
তথ্য কৃতজ্ঞতাঃ আলাউদ্দিন ভূইয়া স্যার ও মাধ্যমিক পঠিত বই।
