ভূমিকা:
কুর্দিস্তান হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রবিহীন জাতির আবাসভূমি। মধ্যপ্রাচ্যে আরব, তুর্কি এবং ফারসিদের পরেই কুর্দিরা চতুর্থ বৃহৎ জাতিগোষ্ঠী। তুরস্ক, ইরাক, ইরান, সিরিয়া এবং আর্মেনিয়ার ২ থেকে ৩ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের আধুনিককালে কুর্দিস্তান বলতে তুরস্কের পূর্বের কিছু অংশ (তুর্কি কুর্দিস্তান), উত্তর ইরাক (ইরাকী কুর্দিস্তান), দক্ষিণ-পশ্চিম ইরান (ইরানি কুর্দিস্তান) এবং উত্তর সিরিয়ার (সিরীয় কুর্দিস্তান) কুর্দি-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিকে বোঝায়। ভৌগলিকভাবে কুর্দিস্তান অঞ্চলটি জগ্রোস পর্বতমালার উত্তর-পশ্চিম অংশ এবং তোরোস পর্বতমালার পূর্বাংশ নিয়ে গঠিত। এছাড়া আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার সামান্য কিছু এলাকাকেও কুর্দিস্তানের অন্তর্গত গণ্য করা হয়।
পাশাপাশি পাঁচটি দেশ জুড়ে বিস্তৃত হলেও ধর্মীয়, ভাষাগত এবং সংস্কৃতিগত দিক থেকে কুর্দিরা মূলত একই জাতি। কুর্দিরা অধিকাংশই সুন্নী মুসলমান, তবে তারা আরব না। তাদের ভাষা কুর্দি ভাষা, যদিও বিভিন্ন এলাকায় এর আঞ্চলিক রূপভেদ আছে। আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে কুর্দিরা অন্যতম বঞ্চিত এবং নির্যাতিত জাতিগোষ্ঠী। দীর্ঘদিন ধরেই তারা তাদের অধিকারের জন্য আন্দোলন করে আসছে।
সম্ভব্য কুর্দি রাষ্ট্র হলে মধ্যপ্রাচ্যের কি ঝুকি তৈরী হবেঃ
১। তুরষ্কের অভ্যন্তরীন রাজনীতিক কাঠামোতে এক ধরনের ঝুকি তৈরী হতে পারে।
২। নব্য প্রতিষ্টিত কুর্দি রাষ্ট্রের সাথে অন্যান্য রাষ্ট্রের সীমান্ত সংঘাত তৈরী হতে পারে।
৩। সম্ভাব্য কুর্দি রাষ্ট্র নিয়ে ন্যটো ও রাশিয়ার দুরত্ব তৈরী হতে পারে । এতে ভু-কৌশলগত অস্ত্র প্রতিযোগিতা তৈরী হতে পারে যা ঐ অঞ্চলের নতুন বলয় তৈরী করতে পারে।
৪। আঞ্চলিক ও পরাশক্তিগুলোর সামরিকায়নের সুযোগ তৈরী হতে পারে ।
৫।কুর্দিস্থানের মত অন্যান্য জাতিগোষ্টীও স্বাধীনতা দাবি করতে পারে যা ঐ অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী সংঘাত কে উস্কে দিতে পারে।
৬। সম্ভাব্য কুর্দিরাষ্ট্রের রাষ্টকাঠামো কি গনতান্ত্রিক হবে,নাকি সমাজতান্ত্রিক হবে নাকি ইসলামী হবে এইটা নিয়ে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে এক ধরনের ভীতি তৈরী হবে।
৭। মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে পরিবর্তন অভ্যন্তরীণ শক্তিগুলোর সংঘাত উস্কে দিতে পারে।
এইসব বাস্তবতাকে চিন্তা করে মধ্যাপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলো নতুন কুর্দিস্তান রাষ্ট্রের অস্বিত্ব মেনে নিতে চায় না। অন্যান্য আঞ্চলিক প্যারামিটারে নিজেদের মতভিন্নতা থাকলেও কুর্দিস্তান প্রসঙ্গে মোটামুটী তুরস্ক,ইরান,ইরাক,সিরিয়া ঐক্যবদ্ধ। ফলে তারা কখনো একসাথে আবার কখনো জোটগতভাবে কুর্দিদের দমনে সর্বশক্তি ব্যয় করছে। এতে বাড়ছে রক্তপাত,প্রানহানি।যা নিম্নে আলোচনা করা হলঃ
কুর্দিদের স্বাধীনতা সংগ্রামঃ
জেনেভা কনভেনশান অনুযায়ী যেকোন জাতির আত্ননিয়ন্ত্রনের অধিকার রয়েছে। সামাজিক সাংস্কৃতিক মিলবন্দনের ফলে নতুন একটি রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখা শুরু হয়। সেদিক থেকে কুর্দিস্তানের জনগনও স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা শুরু করে সেই ১৯২০ এর দশক থেকেই। প্রথম মহাযুদ্ধের পর মিত্রশক্তি যোদ্ধাজাতি কুর্দিদের সিভার্স চুক্তি অনুযায়ী কয়েকটি দেশের মধ্যে বিভক্ত করে দেয়। এই বিভাজন অনুযায়ী কুর্দিরা অন্তত পাঁচটি রাষ্ট্রের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এসব রাষ্ট্র হচ্ছে ইরাক, ইরান, সিরিয়া, তুরস্ক এবং আর্মেনিয়া। কিন্তু এই রাষ্ট্রগুলো কুর্দিস্তানের স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে দেয় নি আর স্বাধীনতাকামী কুর্দিরাও থেমে থাকেনি।
তুরস্ক কুর্দিঃ
১৯২৩ সালে তুরস্কের জন্মের পর থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কুর্দি জাতীয়তাবাদী এবং ধর্মীয় নেতাদের নেতৃত্বে অন্তত ১৬টি কুর্দি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ১৯৭৮ সালে আব্দুল্লাহ ওকালান তুরস্কের কুর্দিদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিতে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (PKK) প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে নতুন করে কুর্দি বিদ্রোহ শুরু হয়। ১৯৮৪ সালে মার্ক্সীয় সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী পিকেকে তুরস্কের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। পিকেকের এ সকল আক্রমণে অন্তত ৪০,০০০ মানুষ নিহত হয় এবং হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়। ২০১২ সালে তুরস্ক পিকেকের সাথে শান্তি আলোচনায় বসে এবং যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। কিন্তু ২০১৫ সালে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) আক্রমণে ৩৩ জন কুর্দি রাজনৈতিক কর্মী নিহত হলে পিকেকে এর জন্য তুরস্কের সরকারকে দায়ী করে এবং তুর্কি পুলিশ ও সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণ শুরু করে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে তুরস্ক পিকেকে এবং আইএসের বিরুদ্ধে যৌথ যুদ্ধ ঘোষণা করে। পিকেকে-ও আইএস এবং তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখে। এরপর থেকে তুরস্ক বনাম আইএস বনাম পিকেকে ত্রিমুখী যুদ্ধে এ পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে
ইরাক কুর্দিঃ
অন্যদিকে ১৯৪৬ সালে মুস্তফা বারজানি (বর্তমান ইরাকের কুর্দিস্তান রেজিওনাল গভর্নমেন্টের প্রেসিডেন্ট মাসুদ বারজানির বাবা) কুর্দিদের স্বায়ত্ত্বশাসন আদায়ের উদ্দেশ্যে কুর্দিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (KDP) প্রতিষ্ঠা করেন। কুর্দিদের উপর ইরাকি সরকারের প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে আশির দশকে ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময়, যখন কুর্দিরা ইরানকে সমর্থন দেয়। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সরকার কুর্দিদের অন্তত ৪,০০০ গ্রাম ধ্বংস করে দেয় এবং সেসব এলাকার অধিবাসীদেরকে অন্যান্য শহরে স্থানান্তরিত করে। ১৯৮৮ সালে সাদ্দাম সরকার ইরাকের হালাবিয়া শহরে কুর্দিদের উপর গ্যাস আক্রমণ করে, যাতে প্রায় ৫০,০০০ মানুষ নিহত হয়।
সিরিয়া কুর্দিঃ
সিরিয়ার কুর্দিদের প্রধান সংগঠন হচ্ছে ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন পার্টি (PYD), যা ২০০৩ সালে তুরস্কের পিকেকের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। এদের সামরিক শাখার নাম পিপল’স প্রটেকশন ইউনিট (YPG)। ২০১৪ সালে PYD এর নেতৃত্বে অন্যান্য কুর্দি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত কুর্দিস্তান ন্যাশনাল কাউন্সিল (KNC) তিনটি কুর্দি প্রধান এলাকা আলেপ্পো, রাক্কা এবং হাশাকার অংশবিশেষ নিয়ে স্বায়ত্ত্বশাসিত গণতান্ত্রিক সরকারের ঘোষণা দেয়। ২০১৪-১৫ সালে আইএস একের পর এক বিভিন্ন এলাকা দখল করতে থাকলে, কুর্দিরা তাদের বিরুদ্ধে অন্যতম শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে আবির্ভূত হয়। ২০১৫ সালে তারা মার্কিন বিমান হামলার সহায়তায় সিরিয়ার কোবানি শহরকে আইএসের হাত থেকে মুক্ত করে।
২০১৫ সালের শেষের দিকে YPG-এর নেতৃত্বে আরব এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের সমন্বয়ে গঠিত হয় সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্স (SDF), যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় আইএসের হাত থেকে সিরিয়ার বিশাল এলাকা মুক্ত করে। সম্প্রতি আইএসের তথাকথিত রাজধানী রাক্কা মুক্তকরণ অভিযানেও নেতৃত্ব দিচ্ছে এই কুর্দি নেতৃত্বাধীন SDF।
স্বাধীনতার পথে কুর্দিদের অর্জনঃ
১। ইরাকী কুর্দিস্তান ১৯৭০ সালে ইরাকি সরকারের সাথে এক চুক্তির মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। ২০০৫ সালে ইরাকের নতুন সংবিধানেও ইরাকি কুর্দিস্তানের এই স্বায়ত্তশাসন পুনরায় স্বীকৃতি পায়।
২। ১৯৯১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো ইরাকের উত্তরাঞ্চলে কুর্দিপ্রধান এলাকাগুলোতে নো-ফ্লাই জোন কার্যকর করে।
৩।গত ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ তারিখে ইরাকি সরকার এবং প্রতিবেশী ইরান ও তুরস্কের প্রবল প্রতিবাদের মুখে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। গণভোটে ইরাকি কুর্দিস্তানের ৯৩ শতাংশ ভোটার স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেয় । যদিও এই গনভোট এখনো কার্যকর হয়নি ।
উপসংহারঃ
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে জাতি ও রাষ্ট্রের বিবিধ সংজ্ঞা রয়েছে। ধর্ম, বর্ণ, নৃগোষ্ঠী, অঞ্চল, অর্থনীতি ও রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়গুলো জাতি গঠনের উপাদান। এক কথায় বলা হয় Sentiment of Oneness ; বা একই মনোভাবের মানুষ হলেই জাতি রূপে পরিগণিত হয়। এই জাতিগোষ্ঠী যখন তার সুদীর্ঘ সংগ্রাম, স্বকীয়তা এবং ধারাবাহিকতা দ্বারা একটি সংগঠন বা সরকার গঠনে সক্ষম হয় তাহলেই তারা জাতিরাষ্ট্র গঠন করে। ইতিহাসের স্তরে স্তরে রয়েছে কুর্দি জনগণের গৌরবোজ্জল অবদান।উপর্যুক্ত বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, কুর্দি জনগোষ্ঠী একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনের দাবি রাখে। দেখা যায় যে, মধ্য যুগে কুর্দি রাষ্ট্রগুলো স্ব-স্বাধীন ছিল। স্বাধীন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য তাদের রয়েছে সুদীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। সাম্রাজ্যবাদ কখনোই এ ধরনের জাতিগুলোকে স্বাধীনতা অর্জনের অধিকার দেয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অধিকার একটি অর্জনের বিষয়। মধ্যপ্রাচ্যের জটিল রাজনীতির আবহাওয়ায় কুর্দি রাষ্ট্রের প্রকাশ বিকাশ এবং লালন একটি কঠিন বাস্তবতা। এতদ্বসত্ত্বেও আমরা আশা করব কুর্দি জনগণের রক্তপাত বৃথা যাবে না।
★তথসুত্রঃ বিভিন্ন গনমাধ্যম এবং
আর্টিকেলের রেফারেন্সে লিখিত
মুহাম্মদ ইরফান উদ্দীন
উপজেলা নির্বাচনী কর্মকর্তা
(৩৭ তম নন ক্যাডার সুপারিশপ্রাপ্ত)