৪১ তম প্রিলিমিনারী পরীক্ষা: প্রশ্ন ব্যবচ্ছেদ, বিশ্লেষণ ও শিক্ষণীয়
___________________________________________________________
বিসিএস প্রিলিমিনারী পরীক্ষা হলো বিসিএস এর লম্বা সোপানে সব চাইতে কঠিনতম ধাপ। এর কারণ হলো প্রতিযোগী সংখ্যা ও এর প্রশ্নের ধরণের অনিশ্চয়তা। এবারের প্রশ্নটি বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাই চাকুরী প্রত্যাশী ভাই-বোনেরা যাতে পরবর্তী পরীক্ষাগুলোতে অধিকতর গোছানো প্রিপারেশন নিতে পারেন এ জন্য আমার এ লেখার প্রয়াস।
সাধারণ জ্ঞান:
বরাবরই সাধারণ জ্ঞান বিষয়টি এর বিশাল ব্যাপ্তির কারণে আমাদের কাছে খুব ভীতিকর মনে হয় এবং এর পেছনেই অধিকাংশ সময় আমরা ব্যায় করে থাকি। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় সাধারণ জ্ঞান বিষয়টি খুব ফ্লাকচুয়েটিং বা পরিবর্তনশীল। বিগত ৮/১০ টি বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারীরর প্রশ্নগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন সর্বোচ্চ ১০% পরিবর্তনশীল! বাকিগুলো একই রকম!!! আগেই কথা শুনে আমার উপর ক্ষেপে যাবেন না প্লিজ। মনোযোগ দিয়ে শুনুন প্লিজ। প্রশ্ন পরিবর্তন বা একই থাকা মানে এই নয় যে একই প্রশ্নের রিপিটিশানের। পরিবর্তন বলতে বুঝিয়েছি প্রশ্নের ধরণে। উদাহরণ দিচ্ছি। এবারের প্রশ্নে বাংলাদেশ এফেয়ার্সে ৩০ টি প্রশ্নের মধ্যে ৯ টি এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে ৫ টি প্রশ্ন এসেছে সাল, তারিখ বা কোন সংখ্যা রিলেটেড প্রশ্ন। অর্থ্যাৎ, ৬০ টি সাধারণ জ্ঞানের মধ্যে ১৪ টি সংখ্যা রিলেটেড প্রশ্ন (২৩% এর অধিক) যা সরাসরি মুখস্থ করতে হয়। পূর্বের প্রশ্নগুলোতেও উল্লেখযোগ্য হারে এমন সাল/ তারিখ সহ সংখ্যাভিত্তিক প্রশ্ন থেকে থাকে।
শিক্ষা: সাল/তারিখ/ সংখ্যাভিত্তিক তথ্য মুখস্থ এড়ানোর কোন সুযোগ নেই। কষ্ট হলেও এগুলো আয়ত্ত্ব করতেই হবে।
এছাড়াও তিন তিনটি সংক্ষিপ্ত টার্মের ইলাবরেশন এসেছে।
শিক্ষা: ইলাবরেশন (পাশাপাশি মুদ্রা, রাজধানী, উপনিবেশ, প্রণালী, ছদ্মনাম, ভিন্ন নাম ইত্যাদি গতানুগতিক প্রশ্ন অবশ্যই আয়ত্ত্ব করে ফেলতে হবে আগামীর জন্য।)।
ব্যাতিক্রম: বরাবরের মতো এবারও কয়েকটি ব্যতিক্রমধর্মী প্রশ্ন এসেছে যা বরাবরই আসে।
যেমন
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলের জন্য ন্যূনতম কতজন ডেলিগেটের সমর্থন প্রয়োজন?
প্রশ্নটি হতে পারতো পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে যা বরাবরই হয়ে থাকে। কিন্তু কেন মশাই আপনাকে সবই গতানুগতিক প্রশ্ন করা হবে? কিছু ব্যতিক্রম থাকবেই। আর এমন কিছু ব্যতিক্রমী প্রশ্ন নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে মূলধারার পড়ালেখাটাকেই মূল প্রস্তুতিতে রাখুন।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য:
এবারের বাংলা ব্যকরণে বাক্যতত্ত্বের আধিপত্য বেশ প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। ৪ টি প্রশ্ন কোন না কোনভাবে বাক্যের ব্যকরণের সাথে সম্পর্কিত। এছাড়াও মৌলিক ব্যকরণের বাইরে তেমন কোন কঠিন বা ব্যতিক্রমধর্মী প্রশ্ন চোখে পড়েনা।
শিক্ষা: নবম/দশম শ্রেণীর ব্যকরণটিই মূল আশ্রয়স্থল।
সাহিত্যের প্রশ্ন বরাবরের মতই গঠনগত দিক থেকে। যেমন- লেখকের/বইয়ের নাম, ছদ্মনাম ইত্যাদি। অল্প দুয়েকটা ব্যতিক্রম ছিল যা বরাবরই থাকে। যেমন: সব চেয়ে কম বয়েসে বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত সাহিত্যিকের নাম বা নজরুলের ১ম বাজেয়াপ্ত বই অথবা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তারাশঙ্করের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা গ্রন্থের নাম। তারাশঙ্করের রচিত বইয়ের নাম মোটামুটি সব পরীক্ষার্থীর কাছেই পরিচিত হবার কথা। এখানে যদি বুদ্ধিমত্তার সাথে চিন্তা করা হয় তাহলে প্রথমেই ভাবতে হবে যে তারাশঙ্করের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাস কি কি উপন্যাস রয়েছে। দ্বিতীয়ত অপশনে উল্লিখিত ৪ টি বইয়ের সবগুলো তারাশঙ্কর রচিত কিনা। চৈতালী ঘূর্ণি এবং ৭১ উপন্যাস দুটি যে তারাশঙ্কর রচিত তা সহজেই জানার কথা। আর বাকি দুটি ভিন্ন লেখকের। এছাড়াও তারাশঙ্করের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক আরও একটি উপন্যাস হলো একটি কালো মেয়ের কথা যা অপশনে নেই। এখন যদি চৈতালী ঘূর্ণির পটভূমি না জানা থাকে তাহলে এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া খুব মুস্কিল। এ ধরণের কনফিউজিং প্রশ্ন এভোয়েড করে যাওয়াই উত্তম।
শিক্ষা: গতানুগতিক সাহিত্যের প্রস্তুতি নিন। ব্যতিক্রম কোন প্রশ্ন পেরে গেলে তা বোনাস। দু/তিনটি ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলা সাহিত্য বেশ গতানুগতিকই ছিল।
গণিত:
গণিত বিষয়টিই বেশিরভাগ পরীক্ষার্থীর কাছে খুব ভীতিকর একটি বিষয়। আমরা জাতিগতভাবেই অংকে দূর্বল। এর প্রধান কারণ আমাদের ক্রিটিকাল চিন্তা করার সুযোগ বা অভ্যাস নেই বললেই চলে। কিন্তু সায়েন্সের ছাত্র না হলে ভালো গণিত পারা যাবেনা এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। বেসিক গণিতে দক্ষতা অর্জনের জন্য আহামরি কোন মেধা প্রয়োজন হয়না। শুধু গণিতকে ভালবেসে কাছে টেনে নিয়ে জয় করার ইচ্ছাশক্তি থাকলেই হলো।
এবারের গণিতে জ্যামিতে থেকে ০৩ টি, পাটিগণিত ৪ টি, কম্বিনেশন পারমুটেশন থেকে ১ টি এবং বীজগণিতে (লগারিদম, সংখ্যা, বর্গ, দশমিকসহ) ১০ টি প্রশ্ন এসেছে। বিবিধ প্রশ্নও এসেছে। গণিতে এবার কোন খুব কঠিন প্রশ্ন চোখে পড়েনি। তবে ক্যালকুলেশনের ধারণাটির উপর জোর দিয়ে কিছু ভগ্নাংশ আর দশমিকের হিসেব কষতে বলা হয়েছে যা খুবই সহজ (একটু অনুশীলন করলে) এবং এ প্রশ্নগুলো সাধারণত জিআরই বা জিম্যাট এ এসে থাকে। যদি কেউ ৩৫তম বিসিএস এর সময় থেকে নবযুক্ত কম্বিনেশন, পারমুটেশন, প্রবাবিলিটি, দ্বিঘাত সমীকরণ ইত্যাদি বাদ দিয়ে প্রস্তুতি নিতে চান তাহলে অনেক সময় বেচে যাবে। আর দক্ষ হলে তো আপনি প্রস্তুতি নিবেনই।
শিক্ষা: গণিত এ পর্যন্ত বিসিএস প্রিলিতে খুব একটা ব্যতিক্রম করেনি। কিছু লিখিত পরীক্ষায় বেশ ব্যাতিক্রম নিয়ে পরীক্ষার্থীদের গলদঘর্ম করে দিয়েছিল (যেমন ৩৫তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষার গণিত প্রশ্ন)।
ইংরেজী ব্যকরণ:
ইংরেজী ব্যাকরণের সব প্রশ্নের মধ্যে মাত্র ২ টি প্রশ্ন ছিল ব্যতিক্রম- ১) একটি বাক্যের কম্পারেটিভ ফর্ম কোনটি? এর বাইরে পার্টস অব স্পিচের উপর বেশ কয়েকটি কঠিন প্রশ্ন করা হয়েছে। বাকী সব প্রশ্ন মোটামুটি পূর্বের প্যাটার্নের মধ্যেই ছিল।
শিক্ষা: পার্টস অব স্পিচ এর উপর বরাবরই প্রশ্ন থাকে। এ টপিকটি আনন্দ নিয়ে পড়লে খুবই মজার এবং যত কঠিন প্রশ্ন হয় তত বেশী মজা লাগে যদি সেভাবে বুঝে প্রস্তুতি নেয়া যায়। ইংরেজী ব্যাকরণ খুবই দারুণভাবে সাজানো। পুরো ব্যাকরণ ভালোভাবে বুঝে আয়ত্ত করার বিকল্প নেই। রাইট ফর্ম অব ভার্বের উপরসহ আরও কয়টি কমন বিষয়ের উপর এবার কোন প্রশ্ন আসেনি। তাই বলে সামনের বিসিএস এ যে রাইট ফর্ম অব ভার্বের (বা অন্য কোন টপিক) আধিপত্য থাকবেনা তা তো বলা যায়না!
ইংরেজী সাহিত্য বরাবরই আনপ্রেডিকটেবল হয়। তবে উক্তি, লেখক, বইয়ের নাম ইত্যাদি গতানুগতিকবাবে মুখস্ত করার কোন বিকল্প নেই যদি না আপনি ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্র না হন।
বিজ্ঞান ও আইসিটি:
এবারের বিজ্ঞানের প্রশ্ন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে পদার্থ বিজ্ঞান থেকে ৪ টি, রসায়ন থেকে ৬ টি, জীববিজ্ঞান থেকে ৩ টি প্রশ্ন এসেছে। এ প্রশ্নগুলোতে এবার ব্যতিক্রম কিছু দেয়নি। বরাবরই বিজ্ঞানের প্রশ্ন এমটাই হয়ে থাকে।
শিক্ষা: আপনি কয়েকটি বই থেকে টপিক ধরে ধরে বিজ্ঞানের প্রস্তুতি নিন যাতে কোন টপিক বাদ না পড়ে। তাহলে বিজ্ঞানে পুরো নম্বরই পাওয়া সম্ভব।
আইসিটির প্রশ্ন বেশ কঠিন হয়েছিল। প্রস্তুতি থাকুক রেগুলার। বিপর্যয় যদি আসে তা সবার উপরই প্রভাব পড়বে। সমস্যা নেই।
নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সুশাসন:
এ বিষয়টি সম্পূর্ণভাবেই পূর্ববর্তী বছরে প্রশ্ন, গাইড আর বই নির্ভর। উক্তি বা তত্ত্ব বাদে কিছু প্রশ্ন আসে যেগুলোর উত্তর প্রায় সবই সঠিক মনে হয়। যেমন এবারের একটি প্রশ্ন:
মূল্যবোধ দৃঢ় হয়-
ক) শিক্ষার মাধ্যমে খ) সুশাসনের মাধ্যমে গ) ধর্মের মাধ্যমে ঘ) গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমে।
এখানে সবগুলোই সঠিক মনে হয়। কিন্তু মুস্কিল হলো প্রশ্নকর্তা যা চেয়েছেন সেটা হতে হবে উত্তর। এ প্রশ্নটির উত্তর যদি কোন বইতে পড়ে থাকেন তাহলে তো হলোই। আর যদি না পড়ে থাকেন এমন প্রশ্নের হাইপোথেটিকাল উত্তর দেবার দরকার নেই।
শেষকথা:
সব কথার শেষ কথা হলো আপনার সফলতা পেতে হলে ০৩ লেয়ারে প্রস্তুতি থাকতে হবে:
১) কঙ্কাল প্রস্তুতি-
মানে গতানুগতিক ধারায় গতানুগতিক যে ধরণের প্রশ্ন এবং টপিক আসে তার সম্পূর্ণ কাভার করা। এটাই আপনার মৌলিক সাফল্যের জায়গা।
২) বেসিক দক্ষতা:
শর্টকাটের যুগে আমরা অনেক কিছু সূত্র, ছন্দ বা নানা টেকনিক দিয়ে মনে রাখি। সে হতেই পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে প্রশ্ন যদি ব্যতিক্রম এবং মৌল জ্ঞান নির্ভর হয় তাহলে কিন্তু বেসিক (বিশেষত গণিত, ইংরেজী, বাংলা ব্যাকরণ) শক্তিশালী করতেই হবে। বেসিক হলো আপনার সবসময়ের সঙ্গী।
৩) বোনাস কাভার:
এর বাইরে আপনি সময়ের প্রাপ্তি সাপেক্ষে অতিরিক্ত কিছু পড়া পড়ে রাখতে পারেন। তবে ধারণক্ষমতার বাইরে চলে গেলে দরকার নেই। এটি আপনাকে কিছু ব্যতিক্রমি প্রশ্ন মোকাবেলায় সহায়তা করবে। তবে এর কলেবর এত বড় যে আপনি এই এক্সট্রা পড়ায় কোনদিনও কোন লাভ নাও পেতে পারেন। তবে হুট করে ২ টা প্রশ্ন কমন পড়ে গেলে সে দুই প্রশ্নের জোরেই কে যানে আপনি কাট মার্কসের গন্ডি পেরিয়ে যেতে পারেন সফলদের তালিকায়।
সবার জন্য শুভকামনা রইলো।
মনোবল হারাবেন না।
সিস্টেম ফলো করলে পড়ালেখা করলে বিসিএস প্রিলিমিনারীতে পার আপনি হবেনই।
সামনে আবারও লেখায় কথা হবে।
ধন্যবাদ ধৈর্য ধরে বকবক পড়ার জন।
***যেকোন ব্যক্তিগত প্রশ্ন থাকলে ইনবক্স করতে দ্বিধাবোধ করবেন না।
_____________________________________________________________
ইমদাদুল হক তালুকদার
সাবেক সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা
সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি), চরভদ্রাসন, ফরিদপুর
মেরিন সেফটি অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, নৌপরিবহন অধিদপ্তর।
৩৫তম বিসিএস (প্রশাসন)
