মো. মাসুদুর রহমান
সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট
৩৭ তম বিসিএস
প্রিলির জন্য আমি যেভাবে এগিয়েছিলাম…
প্রথমত একটা কথা বলতে চাই – “সাকসেস হ্যাস নো শর্টকাট”, কেউ একজন ১ সপ্তাহ পড়ে প্রিলি পাশ করে গিয়েছেন এরকম গল্প অনেকের মুখে শুনলেও বাস্তবে সেই লোকটির সাক্ষাত খুব কমই পাওয়া যাবে। তবে হ্যাঁ, শর্ট প্রিপারেশন নিয়েও যে কারো কারো হয়নি তা কিন্তু না, কেননা প্রিলিটা যতখানি না প্রিপারেশনের তার থেকেও কিছুটা বেশী আমি বলব যে ভাগ্যের প্রসন্নতা। যাই হোক কাজের কথায় চলে আসি। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে যে প্রিপারেশনগুলো আপনাদেরকে নিতে উৎসাহিত করবঃ
১। কোশ্চেন ব্যাংক সলভ করাঃ
এটা অবশ্যই করতে হবে, শুধু এন্সার না, ব্যাখ্যাসহ সবগুলো উত্তর ভালোকরে পড়তে হবে। এক্ষেত্রে আমি ২টি বই ফলো করেছিলাম – অ্যাসিওরেন্স এবং প্রফেসর’স (২ বছরে ২ টা কিনেছিলাম)। সলভ করা প্রশ্নগুলো প্র্যাকটিস করবার জন্য আমি প্লে স্টোর থেকে বিসিএস এর কিছু এপ্লিকেশন নামিয়ে রেখেছিলাম, অবসর সময়গুলোতে সেই এপগুলোতে এক্সাম দিতাম। যে উত্তরগুলো ভুল হত সেগুলো বাসায় গিয়ে বই থেকে আবার ব্যাখ্যাসহ দেখে নিতাম।
২। বিষয়ভিত্তিক প্রস্তুতিঃ
২-১। বাংলাঃ
ক। ড. সৌমিত্র শেখরের “বাংলা প্রশ্নের টীকা-ভাষ্য” নামে একটা বই ছিল, ১২০০ এর উপরে টিকা ছিল তখন ব্যাখ্যাসহ, যেটা শেষ করতে আমার সময় কম লেগেছিল এবং শেষ করার পরে কিছুটা আত্মবিশ্বাস পাচ্ছিলাম নিজের মধ্যে। একটা কথা বলে রাখি এখানে, বই এর সাইজ যত ছোটই হোকনা কেন, পুরো বই শেষ করতে পারার মধ্যে এক ধরনের সাইকোলজিক্যাল পজেটিভিটি কাজ করে, যেটা আমাকে অন্য আর একটা বই শেষ করার ব্যাপারে অনুপ্রেরণা দিত।
খ। সিলেবাস অনুযায়ী “৯ম-১০ম শ্রেণীর বাংলা বোর্ড ব্যাকরণ” বইটি পড়েছি, এখানকার সব টপিক পড়তে হবে না, শুধু যে টপিকগুলো থেকে আগের বছরগুলোতে প্রশ্ন হয়েছে সেটা দেখলেই হবে।
গ। মহসিনা নাজিলার “শীকর বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য” বইটা এখন ভালো করেছে, সৌমিত্র শেখরের টিকা ভাষ্য-এর থেকে এটি কলেবরে বড়, তবে অনেক তথ্যবহুল এবং সহজে পাঠ উপযোগী একটি বই।
২-২। ইংরেজীঃ
ক। “English for Competitive Exam” এটার থেকে ভাল বই পাওয়া কষ্টকর ছিল, কিন্তু বইটা অনেক বড়, শেষ করবার মত সুযোগ হয়ে উঠেনি, তবে এর থেকে বেছে বেছে অনেকগুলো টপিকস পড়েছি, যেগুলো বেশ উপকারে দিয়েছে।
খ। “A Handbook on English Literature” এবং “An Easy Approach to English Literature For BCS Preliminary” বইদুটো ইতিহাস পার্টের জন্য খুবই ভাল কাজে দিয়েছে, তবে কেনার আগে অবশ্যই দেখে নিতে হবে আপেডেটেড প্রশ্নগুলোর ব্যাখ্যাসহ উত্তর দেয়া আছে কিনা।
২-৩। দৈনন্দিন বিজ্ঞানঃ
মূলত “MP3 দৈনন্দিন বিজ্ঞান” বইটাই পড়েছি তবে ইউটিউবের বিজ্ঞানের বেশকিছু ভিডিও আছে যেগুলো হেল্পফুল ছিল, পড়তে পড়তে যখন বিরক্ত লাগত একটা দু’টা গান শোনা/দেখার পর এই ভিডিওগুলো দেখতাম, বিশ্রামও হতো আবার পড়াও হয়ে যেত, তবে হ্যাঁ তথ্যের ভুলের ব্যাপারে একটু সতর্ক থাকতে হবে এক্ষত্রে।
২-৪। কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তিঃ
বিএসসি টা সিএসই-তে হওয়াতে এটা আমার জন্য কিছুটা সহজ ছিল, তবে এক্ষেত্রে MP3 এর কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি বইটা পড়েছি।
২-৫। মানসিক দক্ষতাঃ প্রিলি এবং রিটেনের জন্য একবারে কাজে দেয় এই বইগুলো, আমি অ্যাসিওরেন্স মানসিক দক্ষতা বইটা পড়েছি, তবে এক্ষেত্রে যারা আগে ডিফেন্সের আই.এস.এস.বি-এর প্রথম দিনটা পার করেছেন, তারা খুব সহজেই আগের প্রিপারেশন দিয়ে অনেকটা এগিয়ে থাকতে পারবেন, তা নাহলেও খুব একটা সমস্যা হবে না, এই বিষয়টা তুলনামূলক সহজ এবং একটু মাথা খাটিয়ে পড়লে ভাল নম্বর পাওয়া সম্ভব।
২-৬। ম্যাথঃ
ক। “MP3 Math Review” বইটা পড়েছি
খ। নীলক্ষেতে কিছু ম্যাথ শর্টকাটের বই খুঁজে পেয়েছিলাম, যেটা তাড়াতাড়ি উত্তর খুঁজে পেতে হেল্প করেছে অনেকটা, এমুহুর্তে নামগুলো ঠিক মনে পড়ছেনা।
গ। রবি ১০ মিনিট স্কুলস এর ম্যাথ টিপিস ভিডিওগুলো অবসরে অবশ্যই দেখবেন, এগুলো বেশ কাজে দিয়েছিল আমার।
বলে রাখা ভাল, যারা ম্যাথে দুর্বল, শেষ সময়ের প্রস্তুতিতে কখনই আগে ম্যাথে হাত দিয়ে নিজেকে হতাশ করবেন না (১৫-তে ২-৩ কিছু না পড়ে পাশের জনার কাছ থেকে শুনেও পাওয়া যায় – যদি কপাল ভাল থাকে এতেও চলবে)।
২-৭। বাংলাদেশঃ
ক। MP3 বাংলাদেশ বইটা পড়েছিলাম
খ। ডেইলি একটা নিউজ পেপারের বাংলাদেশ, আন্তর্জাতিক এই দুটো সেকশন পড়তে পারলে সেটা আপনাকে প্রিলি, রিটেন এবং ভাইভা সব ক্ষেত্রে উপকার দেব।
২-৮। আন্তর্জাতিকঃ
ক। MP3 আন্তর্জাতিক বইটা পড়েছিলাম
খ। সাইন্সের স্টুডেন্টদের কাছে এই দিকটা সব সময়ই বিপদের, এজন্য বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক এই দুটোর জন্য আর একটা কাজ করতাম আমি, মডেল টেস্টের তিনটা বই ছিল আমার, সেই বইগুলোর এই সেকশনের প্রশ্নগুলো বারবার দেখতাম।
২-৯। ভূগোলঃ অ্যাসিওরেন্স
২-১০। নৈতিকতাঃ অ্যাসিওরেন্স
৩। নিজেকে যাচাই করাঃ
ক। ৩৭ এর প্রস্তুতির শুরু থেকেই আমি চেষ্টা করতাম সপ্তাহে ৩/৪ টা মডেল টেস্ট দিয়ে নিজের প্রস্তুতিটা যাচাই করার, এক্ষেত্রে আমি শুধু সঠিক দাগানোর প্র্যাকটিস করতাম, শুরুতে যেটা ২৫-৩০ দিয়ে শুরু হয়েছিল সেটা শেষ পর্যন্ত ১৪০-১৫০ সঠিক দাগানোতে আনতে পেরেছিলাম।
খ। প্রিলির একমাস আগে থেকে ডেইলি ৩০-৪০মিনিটে একটা করে মডেল টেস্ট দিতাম। ৩টা বই ছিল – অ্যাসিওরেন্স, প্রফেসর’স, জ্ঞানদ্বিপ এর।
এছাড়াও, ডাইজেস্ট ছিল অ্যাসিওরেন্স এর তবে শেষ সময়ের প্রস্তুতিতে - "প্রফেসর'স এর বিশেষ সংখ্যাটা" শেষ করেছিলাম, খুবই হেল্পফুল ছিল বইটা।
আমার ব্যাপারে কিছু প্রশ্নের উত্তরঃ
#####################
১। এটা আমার তৃতীয় প্রিলি ছিল – ৩৫, ৩৬, ৩৭ (শুধুমাত্র এটাতেই পাশ করেছি)
২। প্রিলির জন্য কোন কোচিং করতে পারিনি, সুযোগ থাকলে হয়ত করতাম, তবে রিটেনের জন্য কোচিং করেছিলাম।
৩। ২০০৯ থেকে জব করছি, তাই জব ছেড়ে দিয়ে প্রিপারেশন নেবার মত ইচ্ছা থাকলেও, আর্থিক টানা পোড়ন দেখাদিলে সেটাতে মানসিকভাবে চাপে পড়ে যেতে পারি ভেবে আর সে পথে আগাইনি, তবে হ্যাঁ ৩৭ মাসের দীর্ঘ পথ চলার মাঝে মানসিক অবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটে থাকে, তাই জবের পাশাপাশি প্রিপারেশন নিতে পাড়লে সেটা সব থেকে উত্তম (যদি জবের পরিবেশটা ভাল হয় তবে)।
৪। যেভাবে পড়তামঃ
ক। ৯-৬ টা অফিসের পর বাসায় এসে (বাসা খুব কাছে ছিল অফিসের) ২ঘন্টা ঘুম দিয়ে রাত ৯টা থেকে ২টা পর্যন্ত চেষ্টা করতাম পড়ার। একদিন ২ ঘন্টা, অন্যদিন ৮ ঘন্টা এভাবে পড়াটা আমার পছন্দ ছিলনা, সবাইকে আমি এটাই বলি যেটাই করবেন একই ভাবে কন্টিনিউ করবেন (মিনিমাম ৩ থেকে ৪ মাস), তাহলে অবশ্যই সেটার পজেটিভ ইমপেক্ট আপনি দেখতে পাবেন ইনশাআল্লাহ।
খ। কালো কালির বই লাল বা নীল কালির কলম অথবা হাইলাইটার দিয়ে মার্ক করে রাখতাম
গ। একি টপিকস টানা না পড়ে, প্রতি সাবজেক্টের ম্যাক্সিমাম ১৫-২০ পেজ পর্যন্ত পড়তাম একটানা – উল্লেখ্য, মুখস্থ বিদ্যায় আমি খুব ভাল না হবার কারনে আমি মুখস্থ করবার জন্য ব্রেনের উপর চাপ না দিয়ে, যে বিষয়গুলো মনে রাখতে কষ্ট হতো সেগুলো ২/৩ দিন পরপরই রিডিং পড়ার মত করে দেখতাম, সব না, শুধুমাত্র হাইলাইট করা অংশগুলো।
ঘ। সাইন্স এবং সিএসই ব্যাকগ্রাউন্ডের হবার কারনে – বিজ্ঞান, আইসিটি, ম্যাথ, মানসিক দক্ষতা এগুলের মার্ক যতটা বাড়ানো যায় সে টার্গেট ছিল সবসময়, এখানে একটা ব্যাপার আছে, পুরানো প্রশ্নগুলো এক্সাটলি রিপিট না হলেও সেম প্যার্টানের প্রশ্ন অনেক আসে, এছাড়াও ঐ বছরের বিভিন্ন গভঃ পরীক্ষার প্রশ্নের সাথে প্রশ্নগুলোর অনেক মিল পাওয়া যায় (বিষয়টা কাকতালীয় না, আমার অভিজ্ঞতা থেকেই আমি এমন মিল খুজে পেয়েছি)।
ঙ। শেষ যে কাজটা আমি করতাম – ৩৫ এর পর কোন প্রিলিই আমি ঢাকাতে দিতাম না কেননা খুলনাতে আমাদের বাসা, খুলনার সুবিধাগুলো হল এখানে যানযট নেই, হলের পরিবেশ যথেষ্ট ফ্রেন্ডলি পেয়েছি, আর রিটেন বিগত ৪/৫ টা বিসিএস একই সেন্টারে হচ্ছে, যেটা আমার বাসা থেকে ১০ মিনিটের পথ মাত্র। যাদের এটলিস্ট যানজট এড়ানোর এই সুযোগটা আছে তারা এটা অবশ্যই নিতে পারেন।
পরিশেষে এটাই বলব, বিসিএস একটি স্বপ্নের নাম, এই চলার পথটা যেমন অনেক দীর্ঘ, তেমনি এই পথে প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে অনেক, আপনার পথের প্রতিবন্ধকতাগুলোকে আপনার নিজের কৌশলেই অতিক্রম করতে হবে, অন্যের দেখানো পথটাই যে আপনাকে অনুসরন করে চলতে হবে ব্যাপারটা কখনই এমন নয়, বরং আমি মনে করি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে শেষ গন্ত্যবে পৌঁছানো যাদের একমাত্র লক্ষ্য তারা নিজেরাই তাদের কৌশল ঠিক বের করে নিতে পারে।