ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে স্বাধীন বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দানকারী দেশ কোনটি? ভারত, নাকি ভুটান? এ নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি রয়েছে স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পরও। বিভিন্ন ভাষ্যমতে, একাত্তরের ৩ ডিসেম্বর মতান্তরে ৭ ডিসেম্বর ভুটান বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল। আবার অনেকে বলে থাকেন, ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল। পরদিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ভুটান।
এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রীয় সর্বশেষ অভিমত হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকার প্রত্যক্ষ সমর্থন ও সহযোগিতা করলেও প্রতিবেশী দেশ ভুটান সবার আগে একাত্তরের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। পরে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ভারত সরকারও একই দিন স্বীকৃতি দেয় নতুন এ রাষ্ট্রকে। ভুটান ও ভারতের এ স্বীকৃতি মুক্তিযুদ্ধকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।
যদিও এ নিয়ে বিতর্ক এখনও পিছু ছাড়ছে না। যেমন, গত ৬ ডিসেম্বর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি প্রকাশিত 'বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী/ কালের কষ্টিপাথরে উত্তীর্ণ' শীর্ষক একটি প্রকাশনায় ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের লেখা একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, '৬ ডিসেম্বর আকাশবাণীর খবরে জানা গেল ভুটান আগে (বাংলাদেশ) স্বীকৃতি দিয়েছে, তার পরপরই ভারত। পরে অবশ্য জানা গেল ভারত আগে স্বীকৃতি দিয়েছে, তারপর ভুটান। ৭ ডিসেম্বর ভারত থেকে প্রকাশিত সব খবরের কাগজে তাই বলা আছে।'
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, 'ভুটান ও ভারত দুই দেশই বাংলাদেশকে ৬ ডিসেম্বর স্বীকৃতি দিয়েছিল। তবে ভারতের কয়েক ঘণ্টা আগে ভুটান স্বীকৃতি দিয়ে তারবার্তা পাঠায়। এটি দালিলিকভাবে এখন প্রমাণিত।' তিনি বলেন, 'ভুটান প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে ৬ ডিসেম্বর একাত্তর সালে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ নিয়ে এখন আর কোনো বিভ্রান্তি নেই।'
দীর্ঘদিন বাংলাদেশের স্বীকৃতিদাতা প্রথম দেশ হিসেবে ভারতের নাম নানাভাবে উচ্চারিত ও প্রচারিত হয়ছে। তবে ২০১৪ সালের ৬ ডিসেম্বর ভুটানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে বাংলাদেশ সফরে এলে এ নিয়ে নতুন তথ্য উঠে আসে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এক বৈঠকে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে বাংলাদেশকে স্বীকৃতির প্রশ্নে দেশটির দালিলিক তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরেন।
এতে দেখা যায়, একাত্তরের ৬ ডিসেম্বর ভুটানের তৎকালীন রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুক এক তারবার্তায় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানিয়ে বলেছিলেন, বিদেশি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশের জনগণের মহান এবং বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম অদূর ভবিষ্যতে সাফল্য লাভ করবে। ভুটানের জনগণ এবং তার প্রত্যাশা, সৃষ্টিকর্তা বর্তমান বিপদ থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করবেন, যাতে তিনি দেশের পুনর্গঠন এবং উন্নয়নের মহান কর্তব্যে দেশ ও দেশের মানুষকে নেতৃত্ব দিতে পারেন।'
এর পর ৯ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ভুটানকে প্রথম স্বীকৃতিদাতা দেশ হিসেবে ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ সরকার। গত বছরের ২০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভুটান সফরে বাংলাদেশ-ভুটান যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৭১-এর ৬ ডিসেম্বর ভুটান বাংলাদেশকে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছেন বলে স্মরণ করেন।
রাষ্ট্র ও সরকারের পাশাপাশি ভুটানের বিভিন্ন গণমাধ্যম আর অনেক সমাজকর্মী এবং জনগণও বাংলাদেশের প্রতি তাদের নৈতিক সমর্থন জানিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা বন্ধ ও বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তির বিষয়ে বিশ্বজনমত গঠনে সরব ছিলেন। এ জন্য ভুটানের সমাজকর্মী উগিয়েন তেসারিংকে ২০১৩ সালে বিদেশি বন্ধু হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা দেয় বাংলাদেশ সরকার। প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপালও বাংলাদেশ প্রশ্নে আন্তর্জাতিক মহলে সোচ্চার ছিল।
এ প্রসঙ্গে প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গঠনের অন্যতম সক্রিয় সংগঠক সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক সমকালকে বলেন, 'লন্ডনে থাকলেও আমরা প্রতিদিনই যুদ্ধের প্রতি মুহূর্তের খবর জানতে উদগ্রীব ছিলাম। তখন নিয়মিত রাশিয়ার ট্রানজিস্টার অ্যাস্টার্ড অ্যারিগ্যায় বিবিসি-১ ও ২-এর খবর শুনতাম। পাশাপাশি আইটিভি এবং আইটিএন চ্যানেলেও খবর দেখতাম। নির্দিষ্ট এ চ্যানেল ও স্টেশনগুলো মুক্তিযুদ্ধের খবর গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করত। তেমনি একদিন শুনলাম, ভুটান বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে স্বীকৃতি দিয়েছে। তখন সবাই উল্লসিত হয়ে উঠি। কিছু পরে ভারতও স্বীকৃতি দিয়েছে- এমন খবর পাওয়ার পর বুঝতে পারি; বিজয় সন্নিকটে।'
তবে মুজিবনগর সরকারের দলিলপত্র, স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র এবং বাংলাদেশ ডকুমেন্টস- এ তিন জায়গাতেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে ভারত প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছে। এতে একাত্তরের ৮ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের দেওয়া বেতার ভাষণকে উদ্বৃত করা হয়। এই ভাষণে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, 'ভারতের জনসাধারণ অনেক আগেই আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছেন তাদের অন্তরে। এখন তাদের সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি জানিয়েছেন। ... ভারতের পর ভুটান স্বীকৃতি দিয়েছে বাংলাদেশকে। এর জন্য ভুটানের রাজা ও জনসাধারণের নিকট কৃতজ্ঞ।' ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকারের আন্তর্জাতিক প্রকাশনা 'বাংলাদেশ'-এর প্রথম বর্ষ ২৪তম সংখ্যায়ও মুখ্য সংবাদ ছিল- 'ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে।' একই সংবাদের বক্স আইটেমে বলা হয়েছিল, 'ভারতের পর ভুটান দ্বিতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে।' মূলত এসব প্রতিবেদন ও ভাষ্যই বাংলাদেশের প্রথম স্বীকৃতিদাতা দেশ নিয়ে বিতর্কের অন্যতম সূত্র।
বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির প্রশ্নে ভারতের বিলম্ব করার কারণ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি সমকালকে বলেন, 'একাত্তরের জুন-জুলাই মাসে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারাভিযান চালাতে যাই। সেখানে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে স্বভাবতই স্বীকৃতির দাবি জানাই। তখন তিনি বলেন, আপনাদের কাছে মনে হতে পারে, এই স্বীকৃতির বিষয়টি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আসলে কিন্তু তা নয়। আধুনিক বিশ্বে সমস্ত বিষয়ে নানা দেশ যুক্ত থাকে। ভারত এই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে। যখন মনে হবে, অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তখনই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে।' ৬ ডিসেম্বর ভারতের লোকসভায় ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেন। তখন ইন্দিরা গান্ধীর উপস্থিতিতে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে (প্রয়াত) ফুলেল শুভেচ্ছাও জানানো হয়।
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানকারী প্রথম মুসলিম দেশ ইরাক। ১৯৭২ সালের ৮ জুলাই ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আহমেদ হাসান আল বকরের শাসনামলে এ স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আফ্রিকান দেশের মধ্যে সেনেগাল রাষ্ট্রপতি সেনঘরের সময় ১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল। ইউরোপ, এমনকি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেও পোল্যান্ড ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দেয়। স্বীকৃতি দানকারী প্রথম আমেরিকান দেশ কানাডা। ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো এ স্বীকৃতি দেন। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অসহযোগিতা করলেও যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল স্বীকৃতি দেয়।
স্বাধীনতা পর এ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ১৫০টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সর্বপ্রথম ভুটান স্বীকৃতি প্রদান করে। ভুটান ও ভারত উভয়েই বাংলাদেশকে একাত্তরের ৬ ডিসেম্বর স্বীকৃতি দিয়েছিল। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া সর্বশেষ রাষ্ট্র চীন। ১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্ট চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
(আবু সালেহ রনি)