৭০ এর দশকে দুই পরাশক্তির একটি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অন্যটি সোভিয়েত ইউনিয়ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও চীনের মাওবাদী সরকার মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পাশে এসে দাঁড়ালে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকার উপলদ্ধি করে বৃহৎ শক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন এবং আন্তর্জাতিক মহলের সহানুভূতি না পেলে এ যুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভব হবে না । তখন প্রবাসী সরকার আর্ন্তজাতিক সমর্থনের আশায় ৭১ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে হাঙ্গেরীর বুদাপেস্টে অনুষ্ঠিত ‘বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে’ ৩ সদস্যের প্রতিনিধি দল পাঠায়। যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন প্রয়াত আব্দুস সামাদ আজাদ। অপর দুই সদস্যের একজন তিনি এবং অন্যজন ন্যাপের দেওয়ান মাহবুব আলী ছিলেন। ভারত সরকারও তখন বিকে কৃষ্ণ মেননের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে সম্মেলনে।
পরে প্রবাসী সরকারের পক্ষে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সমর্থন আদায়ের জন্য সম্মেলনের পর তাদের মস্কো, পূর্ব বার্লিন ও পোল্যান্ড সফর করেন । স্বাধীনতার পক্ষে মূলত মস্কোর দ্বিধা দূর করতেই তাদের এ সফর করতে হয়েছে। তখন মস্কোর ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ছিলেন গীতিধর। যিনি পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ বিষয়ক মূল উপদেষ্টা হয়েছিলেন।এই গীতিধরই বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলকে অর্থাৎ তাদের প্রক্রিয়াধীন ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন মৈত্রী চুক্তির কথা জানান এবং বলেন, চুক্তিটি সম্পন্ন হলে বাংলাদেশের পক্ষে ভারতের সহযোগিতা আরো সহজতর হবে। সত্যিই চুক্তিটি সম্পন্ন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের পক্ষ নেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন ।বাংলাদেশের সাথে সরাসরি কোন সম্পর্ক না থাকলেও যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি নির্ধারনে অন্যতম নিয়ামকের ভূমিকা রাখে এটি।মূলত এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পরই বাংলাদেশে প্রশ্নে সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি সুস্পষ্ট অবস্থানে আসে।আন্তর্জাতিক ফ্রন্টে বাংলাদেশকে একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করে দেয় এই চুক্তি,ভারতের পাশাপাশি আরো একটি পরম মিত্র পেয়ে যায় বাংলাদেশ - সোভিয়েত ইউনিয়ন। জুলাই মাস পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের মনোভাবে একটি দোদুল্যমান অবস্থা দেখা যায়,গণহত্যার নিন্দা জানালেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে চুপ থাকে তারা,পাকিস্তানের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্কও বজায় রাখে।এ পর্যন্ত পাকিস্তান সংক্রান্ত বিষয়সমূহকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন ব্যাপার বলেই মনে করে তারা।পরিস্থিতির পরিবর্তন হয় জুলাইয়ের পনেরো তারিখ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন চিন সফরের ঘোষণা দিলে।এর পর পরই সোভিয়েত কূটনীতিতে বড় ধরণের পরিবর্তন আসে।দুই কূল রক্ষা নীতি থেকে সরে এসে ভারতের দিকে ঝুঁকে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন।বস্তুত,চিনের সাথে আদর্শগত বিরোধের প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র-চিন জোট শক্তিশালী হয়ে ওঠার আশঙ্কায় পুরনো মিত্র ভারতের প্রতি মনোযোগী হয় তারাএবং তাদের ধারণা ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী দেশটি হলো পাকিস্তান।ধারণাটি ভুল ছিল না। এর কিছুদিন পরেই ৯ অগাস্ট ভারতের সাথে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করেন দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং ও আন্দ্রে গ্রমিকো।।চুক্তির পর বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী যেকোন উদ্যোগের বিপরীতে অবস্থান নেয়ার নীতি গ্রহণ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তির একটি অপশন ছিল দুই পক্ষের কেউ যদি তৃতীয় কারো দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাহলে পারস্পারিক আলোচনার মাধ্যমে একে অন্যকে সহযোগিতা করবে। এই অপশনের কারণেই পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের পক্ষ নেয় এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের পক্ষে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে এবং ৩ বার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে।
জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রশ্নে যেসব বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে সোভিয়েত প্রতিক্রিয়ায় এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যুদ্ধবিরতির প্রশ্নে ক্রমাগত ভেটো দানও এরই ফল।এবং এসব কিছুর সূত্রপাত মৈত্রী চুক্তিটি থেকেই।এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ফ্রন্টে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়া ভারত তার মোটামুটি নিঃসঙ্গ অবস্থা কাটিয়ে উঠে একটি শক্তিশালী মিত্রকে পাশে পায়। চুক্তিটির তাতক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।চুক্তির খবর প্রকাশিত হবার পর পর বাংলাদেশের ব্যাপারে যুদ্ধংদেহী অবস্থানে চলে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা দমে যায়।একেবারেই ব্যাকফুটে চলে যায় চিন।পাকিস্তানের আশা ছিল চলমান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের কাছ থেকে সরাসরি সামরিক সাহায়তা পাবে তারা।চুক্তির সাথে সাথে পাকিস্তানের এই আশা মিলিয়ে যায়।বিশেষজ্ঞদের মতে,চুক্তিটির সুদূর প্রসারী প্রতিক্রিয়া মাথায় রেখেই চিন পাকিস্তানের পক্ষে এবং বাংলাদেশ-ভারতের বিপক্ষে বড় ধরণের পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকে।
এভাবে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনায় দেখা যাবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ ঘটেছিল। প্রতিদ্বন্দ্বী শিবির দুটির নেতৃত্বে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন। ঘটনাপ্রবাহে সবচেয়ে লাভবান হয়েছিল বাংলাদেশ , অন্যদিকে সম্পূর্ণ বিপরীত ও ধ্বংসাত্মক পরিণতি বরণ করেছিল পাকিস্তান। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে প্রকাশ্য কূটনৈতিক সমর্থন বেশি পেলেও পাকিস্তান তার ভাঙন ও পরাজয় এড়াতে পারেনি। সবকিছুর পেছনে নির্ধারকের ভূমিকা রেখেছিল বাংলাদেশের জনগণ। স্বাধীনতার জন্য তাদের আত্মত্যাগ ও বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের কাছে পাকিস্তান ও তার সমর্থকরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল। বিশ্লেষণের এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনগণই আসলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মেরুকরণ ঘটিয়েছিল।
//কোন সাজেশান থাকলে কমেন্টে জানাবেন ।
সুত্রঃ ১। 1971: Genocide-Torture Archive & Museum হতে সংগৃহিত ও সম্পাদিত লিখা//
★কপি করলে কার্টেসি দিতে ভুলবেন না
মুহাম্মদ ইরফান উদ্দীন
উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা(সুপারিশপ্রাপ্ত)
৩৭ তম বিসিএস নন-ক্যাডার